ইউনূস সরে দাঁড়ানোয় সুশীল সমাজের একটি অংশ হতাশ

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্তে হতাশ হয়ে পড়েছে দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ। এই হতাশার কথা খোলাখুলি বলেছেনও তারা। রাজনৈতিক অভিলাষ পূর্ণ না হওয়ায় এদের কেউ কেউ মুষড়ে পড়লেও এখনো হাল ছেড়ে দিতে নারাজ সুশীল সমাজের এই অংশটি। ড. ইউনূস ব্যর্থ হলেও তারা অন্য কাউকে দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে আবার স্বাগত জানিয়েছেন ড. ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্তকে।

সুশীল সমাজের একটি প্রভাবশালী অংশ ও কিছু রাজনীতিকের উৎসাহে রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিন’ তাকে গাছে তুলে এক পর্যায়ে মই সরিয়ে নেন এদের কেউ কেউ। এর ফলে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন এই নোবেল বিজয়ী। আর এ কারণেই রাজনৈতিক
দল গঠনের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন তিনি। এ কথা ড. ইউনূস নিজেই বলেছেন বৃহস্পতিবার নাগরিকদের উদ্দেশে লেখা তার সর্বশেষ খোলা চিঠিতে। আর রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে যারা ড. ইউনূসের সামর্থ্য ও ভাবমূর্তির ওপর ভর করে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই তারা এখন হতাশ। অবশ্য তাদের এই হতাশার আরো কারণ আছে। দেখা গেছে সুশীল সমাজ পরিচয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ‘নতুন ধারা’র রাজনীতির কথা বলে তৎপরতা চালিয়ে এলেও তাদের এই পরিচয় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কোনো গুরুত্ব পায়নি। সমপ্রতি নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজের সঙ্গে নির্বাচনী সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দাবিদার কাউকে এই আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের’। তা ছাড়া নির্বাচনী সংস্কার আইনের খসড়ায় এনজিও কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করায় সুশীল সমাজের যারা আগামীতে ভোটযুদ্ধে নামার স্বপ্ন দেখছিলেন তাদের সে স্বপ্নও হোঁচট খেয়েছে দারুণভাবে। এতোসব হতাশার মাঝে ড. ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার ঘোষণায় তাদের হতাশার ষোলকলা পূর্ণ হলো। এই হতাশার সুর ঝরে পড়েছে তাদের অনেকের কথায়।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান ভোরের কাগজকে বলেছেন, আমাদের দেশের রাজনীতি তো নোংরা হয়ে গেছে। ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার ঘোষণায় আমরা আশা করেছিলাম দুটি দলের জগদ্দল দশা থেকে আমাদের রাজনীতি মুক্তি পাবে। কিন্তু তা হলো না। ড. ইউনুস সাধারণ মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন। রাজনীতিকদের সমর্থন পাননি। এমন কি কেউ কেউ তাকে কটাক্ষও করেছেন। এম হাফিজ উদ্দিন খান মনে করেন, রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্ত ড. ইউনূসের পক্ষে হয়তো সঠিকই হয়েছে। কিন্তু দেশ-জাতির জন্য শুভ হয়নি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্তে আমি খুবই দুঃখিত হয়েছি। তার মতো সৎ ও যোগ্য ব্যক্তির রাজনীতিতে যুক্ত থাকা উচিত ছিল। এতে রাজনীতি আরো সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশ তার সেবা থেকে বঞ্চিত হলো।
হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর উন্নয়ন চিন্তাবিদ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ড. ইউনূসের সিদ্ধান্তকে আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন’ তার রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ড. মজুমদার আরো বলেন, ভালো মানুষের রাজনীতিতে প্রবেশেই কোথায় যেন একটা বাধা। ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতে পারেন না। এটা দেশের জন্য ভালো নয়। দেশের রাজনীতিতে আমরা যে নতুন স্পিরিট ও নেতৃত্ব আশা করেছিলাম ড. ইউনূসের রাজনীতিতে না আসার সিদ্ধান্তে তা অপূর্ণই থেকে গেলো।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, আমাদের যে অস্থির ও কলুষযুক্ত রাজনীতি তাতে ভালো মানুষের রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ অভিনন্দনযোগ্য। কিন’ বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যথাযথ পূর্বপরিকল্পনা, সুষ্ঠু, সংহত ও ব্যাপক জনসমর্থন ছাড়া রাজনীতিতে আসা সম্ভব নয়। ড. শেলী বলেন, ড. ইউনূস রাজনীতিতে আসার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন হলে ভালোই হতো। কিন’ তা হয়নি। ড. ইউনূসের পক্ষে সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে অন্য কারোর পক্ষেও যদি সম্ভব হয় তা হলে তা দেশের জন্য, মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ইউপিআর প্রধান আ স ম আব্দুর রব বলেন, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে ড. ইউনূসের মতো জাতির একজন কৃতী সন্তানকে আমরা রাজনীতিতে পেলাম না। তিনি একজন উন্নত চিন্তার মানুষ। তিনি আগামীতে নতুন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। আমি অত্যন্ত আশাবাদী যে ভবিষ্যতে সে রকম দল ও নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি প্রফেসর আতাউর রহমান বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্ব রাজনীতিতে আসতে পারলেন না। এটা যে আমাদের দেশের রূঢ় বাস্তবতা এর মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হলো। প্রফেসর আতাউর রহমান বলেন, ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার প্রক্রিয়ায় কৌশলগত কিছু ভুল ছিল। তায় আরেকটু চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। এছাড়া প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসাটাকে তাদের জন্য একটা হুমকি হিসেবে দেখেছে। তারা তাকে স্বাগত জানাননি। প্রফেসর আতাউর রহমানের মতে, ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা ভিশন ছিল। কিন’ জনগণের আকাঙক্ষাকে তিনি অনুধাবন করতে পারেননি।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক ছিল না। হঠাৎ করেই তিনি ঘোষণা দিলেন রাজনীতিতে আসবেন। এভাবে একটি দল হয়ে যাবে, লোকে সাড়া দেবে এটা ভাবাই তো অযৌক্তিক।

তিনি বলেন, দল করতে হলে আগে আদর্শ ও লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সমমনা লোকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এটা শুধু ওপর থেকে সুশীল সমাজ ও কিছু রাজনীতিককে নিয়ে করলেই হবে না। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত করতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, ড. ইউনূস যে ব্যর্থ হয়েছেন- তার এই ব্যর্থতার বীজ নিহিত ছিল তার উদ্যোগের মধ্যেই। উদ্যোগটাই স্বাভাবিক ছিল না। তিনি প্রচলিত রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন’ শুধু তিনি ভালো অন্যরা খারাপ এটা ঠিক নয়। অন্যরা খারাপ এটা আমরা জানি। কিন্তু তিনি যে ভালো এটা কী করে বুঝবো। তিনি যাদের সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন তারাও তো পরীক্ষিত নয়। কাজেই আমি বলবো, ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার ঘোষণা ছিল অস্বাভাবিক; সে কারণেই তার রাজনীতিতে আসা থেকে বিরত থাকার ঘোষণাটা খুবই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার গোটা প্রক্রিয়ারই সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই দেশের জন্য বড়ো কিছু করার আকাঙক্ষা থেকে নতুন ধারার রাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, প্রচলিত রাজনীতিকরা টাকার পেছনে ছুটছেন। এই প্রক্রিয়ায় এক মাস পার করার পর এখন দল গঠন থেকে বিরত থাকার কথা বলছেন। এ সময় তিনি জনসমর্থন যাচাইয়ের জন্য খোলা চিঠি দিলেন, মতামত চাইলেন। তিনি যখন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলেন দেশে তখন জরুরি অবস্থা চলছিল, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমি তখনই বলেছিলাম, জরুরি অবস্থার মধ্যে দল গঠনের কথা বলা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত?

আবুল বারকাত আরো বলেন, ড. ইউনূস যে দল গঠন করতে চেয়েছিলেন তার দলের লক্ষ্য ও আদর্শ কী? রাজনীতিকরা টাকার পেছনে ছুটছেন বলে তিনি দোষারোপ করলেন। তার মতে টাকার পেছনে যারা ছুটছেন না তারা কারা? দল গঠনের প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন, আরো কিছু দিন অপেক্ষা করলেও আমি সফল হবো না। অধ্যাপক আবুল বারকাত প্রফেসর ইউনূসকে উধ্বৃত করে বলেন, তারা কারা ড. ইউনূস যাদেরকে সঙ্গে পাচ্ছিলেন না। তারা কি ভীতু না সুবিধাবাদী? তারা কেন ড. ইউনূসকে উৎসাহ দিলেন কিন্তু এখন তার সঙ্গে থাকছেন না। কী তাদের অসুবিধা?
আবুল বারকাত আরো বলেন, ড. ইউনূস আগামী ৫ বছরে যে সম্ভাবনার কথা শুনিয়েছেন এর কোনো কথাই নতুন নয়। তিনি একজন দার্শনিক। আমরা আশা করবো তিনি অন্য কিছু, নতুন কিছু বলবেন। Source:ভোরের কাগজ
Date:2007-05-06

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান